অধ্যায় ৩
কর্মযোগ
শ্লোক:
1. অর্জুন বললেন- হে জনার্ধন, হে কেশব, যদি তোমার মতে ভক্তি বিষয়াদি বুদ্ধি কর্ম থেকে শ্রেয়তর হয় তাহলে কেন আমাকে ভয়ানক যুদ্ধে নিযুক্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করছ।
2. তুমি সন্দেহজনক রুপে প্রতীয়মান বাক্যের দ্বারা আমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত করছ। তাই দয়া করে আমাকে নিশ্চিতভাবে বল কোনটি আমার পক্ষে সব চেয়ে শ্রেয়স্কর।
3. ভগবান বললেন- হে অর্জুন, আমি ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি যে দুই প্রকার মানুষ আধ্যাত্ম্যচেতনা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। আর কিছু লোক দার্শনিক জ্ঞানের আলোচনার মাধ্যমে নিজেকে জানতে চান এবং অন্যেরা আবার তা ভক্তির মাধ্যমে জানতে চান।
4. কেবল কর্ম অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও কেবল সিদ্ধি লাভ করা যায় না।
5. সকলেই অসহায়ভাবে মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কর্ম করতে বাধ্য হয় তাই কর্ম না করে ক্ষণকাল থাকতে পারে না।
6. মুঢ়ব্যক্তি পঞ্চকর্ম ইন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ রসাদি ইন্দ্রিয়গুলি স্মরণ করে, সে অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারি ভন্ড বলা হয়।
7. কিন্তু যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্ম অনুষ্ঠান করেন তিনি পূর্বক্ত মিথ্যাচারি অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।
8. তুমি শাস্ত্রে উক্ত কর্ম অনুষ্ঠান কর কেননা কর্মত্যাগ থেকে কর্ম অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রা নির্বাহ করতে পারে না।
9. বিষ্ণুর প্রতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত নাহলে কর্ম জীবকে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে। তাই হে কৌন্তেয়, ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তোমার কর্তব্য অনুষ্ঠান কর এবং তার ফলে তুমি সদা সর্বদা জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
10. সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান যজ্ঞসহ প্রজা সৃষ্টি করে বলেছিলেন । এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা সর্বদা সমৃদ্ধ হও, এই যজ্ঞ তোমাদের সমস্ত অভীষ্ট পূরণ করবে।
11. তোমাদের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে প্রীত হয়ে দেবতারা তোমাদের প্রীতি সাধন করবেন। এইভাবে পরস্পরের প্রীতি সম্পাদন করার মাধ্যমে তোমরা পরম মঙ্গল লাভ করবে।
12. যজ্ঞের ফলে সন্তুষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের প্রতি বাঞ্চিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। সুতরাং দেবতাদের দেওয়া বস্তু তাদের নিবেদন না করে যিনি ভোগ করেন তিনি নিশ্চয় চোর।
13. ভগবান ভক্তরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন কারণ তারা ভগবানকে নিবেদন করে অন্ন গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য অন্নপাক করে তারা কেবল পাপ ভোজন করে।
14. অন্ন গ্রহণ করে প্রাণীরা জীবন ধারণ করে, বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপাদন হয়, যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি হয়।
15. যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভব হয়েছে এবং বেদ অক্ষর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
16. হে অর্জুন, যে ব্যক্তি এই প্রকারে ভগবান কর্তৃক প্রবর্তিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয় সুখপরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।
17. যে ব্যক্তি আত্মাতে প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত, আত্মাতেই সন্তুষ্ট তার কোন কর্তব্য নেই।
18. আত্মানন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির ইহজগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।
19. অতএব কর্মফলের প্রতি অনাসক্ত হয়েই কর্তব্য কর্ম সম্পাদন কর, অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই পরম ভক্তি লাভ করা যায়।
20. জনক প্রভৃতি মহারাজরাও কর্ম দ্বারা ভক্তিরুপ সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন, অতএব জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।
21. শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে ভাবে আচরণ করেন সাধারন মানুষেরাও তার অনুকরণ করেন। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন অন্য লোকে তারই অনুকরণ করে।
22. হে পার্থ, এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।
23. হে পার্থ, আমি যদি অলস হয়ে শুভকর্মে প্রবৃত্ত না হই তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।
24. আমি যদি কর্ম না করি সমস্ত লোক ভ্রষ্ট হবে। আমি বর্ণসঙ্কর আদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ হব এবং তার ফলে সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হবে।
25. হে ভারত, অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্য কর্ম করে তেমনি জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে প্রকৃত পথে মানুষকে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করেন।
26. জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করে না। তারা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করে।
27. মোহাচ্ছন্ন জীব প্রকৃত অহঙ্কারবশত জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে এবং আমি কর্তা- এই রকম অভিমান করে।
28. হে মহাবাহো, জ্ঞানী ব্যক্তি ভগবদ্-উক্তিমূখী কর্ম এবং সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে কখনো ইন্দ্রিয় সুখ ভোগাত্মক কার্য্যে প্রবৃত্ত হন না।
29. জড় প্রকৃতির ত্রিগুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের সেই কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষেরা তাদের বিচলিত করে না।
30. হে অর্জুন, তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ করে আধ্যাত্ম্য চেতনা সম্পন্ন হয়ে মমতাশুন্য, নিষ্কাম ও শোকশুন্য হয়ে যুদ্ধ কর।
31. আমার নির্দেশ অনুসারে শ্রদ্ধাবান হয়ে যিনি তার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন, তিনি কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।
32. কিন্ত যারা আমার এই উপদেশ পালন করে না তাদের সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।
33. গুণবান ব্যক্তিও তার প্রকৃতি অনুসারে কার্য করেন কারণ সকলেই তাদের স্বীয় স্বভাবকে অনুগমন করেন। সুতরাং দমন করে কি লাভ হবে?
34. সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এইভাবে ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারন তা পরমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।
35. স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরুপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয় তাও মঙ্গলজনক কিংবা অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপদজনক।
36. অর্জুন বললেন- হে বাঞ্চেয়, মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচারণে প্রবৃত্ত হয়?
37. ভগবান বললেন- হে অর্জুন, রজোগুণ থেকে কাম মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম হল সর্বগ্রাসী এবং পাপাত্মক; কামকেই জীবনের প্রধান শত্রু বলে জানবে।
38. অগ্নি যেমন ধূম্রদ্বারা আবৃত থাকে এবং দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ু দ্বারা আবৃত থাকে তেমনই জীবসত্ত্বা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।
39. কামরুপী চিরশত্রু দ্বারা মানুষের শুদ্ধ চেতনা আবৃত। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মত চির অতৃপ্ত।
40. ইন্দ্রিয়সমূহ, মন এবং বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল, যার মাধ্যমে কাম জীবের প্রকৃতজ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।
41. অতএব হে ভারতশ্রেষ্ট, তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান নাশক পাপের প্রতীকরুপ কামকে বিনাশ কর।
42. জড়পদার্থের থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়, ইন্দ্রিয়ের থেকে মন শ্রেয়, মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয় এবং তিনি (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।
43. হে মহাবীর অর্জুন, নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধির অতীত জেনে চিন্তাশক্তির দ্বারা নিকৃষ্ট বৃত্তিকে সংযত করে কামরুপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।
No comments:
Post a Comment